‘ক্লাসলেস লোকেরা বাংলা সিনেমা দেখে’, আজকে কথায় কথায় এই কথাটা শুনতে হত না, যদি আমরা আমজাদ হোসেনদের মূল্যায়ন করতে পারতাম। বাংলা চলচ্চিত্রের শুরু থেকে মধ্যগগন পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ানো আমজাদ হোসেনের অভাববোধ করছি চলচ্চিত্রের প্রত্যেকটা শাখা-প্রশাখায়। সেটা প্রযোজক, পরিচালক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা কিংবা গীতিকার, যে হিসেবেই হোক না কেনো ! প্রতিটা মাধ্যমেই আমজাদ হোসেন রেখেছেন নিজের স্বতন্ত্রতা। ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট জামালপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করা আমজাদ হোসেনকে নিয়েই আজকের এই লেখা।
সাহিত্যে আমজাদ হোসেন
স্কুল জীবন থেকেই সাহিত্যে ঝোঁক ছিলো। তারই পরিপ্রেক্ষিতে লিখতেন কবিতাও। মূলত সাহিত্য দিয়েই সৃজনশীল মাধম্যে প্রবেশ করেন আমজাদ হোসেন। কলেজে পড়া অবস্থায় কলকাতার বিখ্যাত দেশ পত্রিকায় ছাপা হয় তার প্রথম কবিতা। সে সময়ে দেশ পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হওয়া একজন নতুন লেখকের জন্য অনেক বড়কিছু ছিলো। তারই প্রেক্ষিতে কলকাতায় থাকা খাওয়ার অফার পান, সাহসের অভাবে যেতে পারেননি। ওই সময় না পারলেও থেমে থাকেনি তাঁর লেখালিখি। একে একে লিখেছেন ‘ধ্রুপদী এখন ট্রেনে (যেটা থেকে পরবর্তীতে গোলাপী এখন ট্রেনে নির্মান করেছিলেন), আগুনের অলংকার, শেষ রজনী, মাধবীর মাধব, মাধবী সংবাদ, দ্বিধাদ্বন্দের ভালবাসা, ঝড়া ফুল’ সহ অসংখ্য উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি অন্তরব ধারণ করেন। আমজাদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধ এবং ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তাইতো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন ‘যুদ্ধে যাবো, অবেলায় অসময়, উত্তরকাল, যুদ্ধযাত্রার রাত্রি’ গ্রন্থগুলো। এছাড়াও লিখেছেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু, শ্রী হেমন্ত চক্রবর্তীর মত বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী। হাত পাকিয়েছেন কিশোর উপন্যাস এমনকি ফিকশনেও !
চলচ্চিত্রে আমজাদ হোসেন
আমজাদ হোসেনের চলচ্চিত্রে আগমন মঞ্চ থেকে। ২০টাকা বেতনে কাজ করেছিলেন। ঢাকা হলে বসে লিখেছিলেন ‘ধারাপার’ নাটকটি, যেটা মঞ্চস্থ হওয়ার পর চারিদিকে হইছই পড়ে যায়। এমনকি সৈয়দ শামসুল হক দৈনিক ইত্তেফাকে ধারাপারের প্রশংসা করে কলাম লিখেছিলেন। ধারাপাতের তখনো অনেক বাকি, এরইমাঝে তিনি সেটাকে রূপ দিতে চাইলেন বড় পর্দায়। তার আগেই অভিনয় করলেন শ্রদ্ধেয় মহিউদ্দিনের “হারানোর সুর” সিনেমায়। তবে আলোচনায় আসলেন সেই ধারাপাত দিয়েই। এরই রেশ ধরে যুক্ত হয়েছিলেন জহির রায়হানের ইউনিটে। কিন্তু নামস্বত্ব না পাওয়ায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ৩০তম পরিচালক হিসেবে আমজাদ হোসেনের অভিষেক হয় ‘জুলেখা’ দিয়ে।
আমজাদ হোসেন এবং একটি জীবন থেকে নেওয়া
সময়টা ১৯৬৯, তখন জহির রায়হান সবেমাত্র করাচি থেকে ফিরেছেন। শহীদ আসাদের লাশ নিয়ে শহীদ মিনারে ঘুরছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। লাশ দাফন করা হলো। দাফন শেষে ভাসানী আমজাদ হোসেনের মাথায় হাত রেখে আসাদের উপর একটা ডকুমেন্টারি বানাতে বললেন। সে হিসেবেই চিত্রনাট্য লিখলেন আমজাদ হোসেন, কিন্তু আসাদের পরিবার ডকুমেন্টারি বানাতে আপত্তি জানায়। যার ফলে শহীদ আসাদের উপর ডকুমেন্টারি বানানো সম্ভব হয়নি। ওই চিত্রনাট্যটা পরিবর্তন করে জহির রায়হান এবং আমজাদ হোসেন মিলে নির্মাণ করলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’। একটা পরিবার, একটা পানের বাটা, একটা সন্তান, একটা চাবির গোছা, একটা আন্দোলন, এ নিয়েই নির্মাণ হলো ‘জীবন থেকে নেওয়া’।
একদিকে তৎকালীন জীবন ঘনিষ্ঠতা অন্যদিকে স্বাধিকার আন্দোলন, ‘জীবন থেকে নেওয়া’ নামের মতই জীবন্ত ! এই সিনেমাতেই প্রথম ব্যবহার হয়েছিলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই সিনেমা দিয়েই আমরা পেয়েছি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি। ব্যবহার হয়েছিলো কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারারই লৌহ কপাট’ গানটি। আমজাদ হোসেনের গল্পভাবনা এবং জহির রায়হানের নির্মাণশৈলী ‘জীবন থেকে নেওয়া’কে এনে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রামান্য দলিলের সম্মান।
শ্রেণীবৈষম্য এবং ভাত দে
যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা শ্রেণীবৈষম্যের গল্প হলো ‘ভাত দে’। বারবার শাসিতের দ্বারা শোষিতের অসহায়ত্বের গল্প এই ‘ভাত দে’। শ্রমিকের ঘামের বিন্দুতে জমে থাকা বঞ্চনার দাগ, একমুঠো ভাতের জন্য ক্ষুদার্থ পেটের হাহাকার নিয়েই নির্মিত হয়েছে এ চলচ্চিত্রটি। জীবনকে কত কাছ থেকে দেখলে এমন গল্প বলা যায়, সেটা আমজাদ হোসেনই জানেন। দরিদ্র বাউলের অভাবের সংসারে টিকতে না পেরে ছোট্ট বাচ্চা রেখে পরপুরুষের সাথে পালিয়ে যাওয়া, যুবতী মেয়ে রেখে অন্ধ বাউলের পরপার যাত্রা, শাসক শ্রেণীর দেহলোভ। সমাজের প্রতিটা নির্মম সত্য উঠে এসেছে প্রতিটা দৃশ্যে।
সম্ভবত শাবানা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়টা করেছিলেন এই সিনেমাতে। ‘ভাত দে’ সিনেমাটি সে বছর ৯টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলো, যা কিনা প্রায় চার দশক ধরে রেকর্ড হয়েই ছিলো। প্রথম বাংলা সিনেমা হিসেবে ‘ভাত দে’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।
নির্মাতা হিসেবে আমজাদ হোসেন আরো অনেক কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। যার মধ্যে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরি, ‘কসাই, দুই পয়সার আলতা, জন্ম থেকে জ্বলছি, কাল সকালে’ অন্যতম।
গীতিকার আমজাদ হোসেন
একজন ভার্সেটাইল আমজাদ হোসেন শিল্পের যে শাখায় হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। ঠিক যেমন তিনি গীতিকার হিসেবে উপহার দিয়েছেন বহু কালজয়ী গান। “আছেন আমার মোক্তার, হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ, কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিলো না, চুল ধইরো না খোপা খুলে যাবে, একবার যদি কেউ ভালোবাসতো, বাবা বলে গেলো আর কোনদিন গান করো না” সহ অসংখ্য ক্ল্যাসিক গানের কথা আমজাদ হোসেনের।
লেখকের মতামত
আমজাদ হোসেন শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি না, আমজাদ হোসেন অনেকগুলো প্রতিভার মিলিত রূপ। আজকে আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির দুর্দিনে কিছু মূর্খ ও জ্ঞানহীনরা যখন আমাদেরকে মেধাশূন্য জাতি হিসেবে মূল্যায়ন করতে চায়, তখন এক আমজাদ হোসেনই যথেষ্ট ওদের মুখে জোরে চপেটাঘাত করার জন্য। আমরা সোনালী দিন ফেলে এসেছি, চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে এখন দূর্ভিক্ষ লেগেছে। কেনো এমনটা হয়েছে জানেন?
কারণ আমরা এত বছরেও আর কোনো আমজাদ হোসেনকে পাইনি। পাইনি, কারণ আমরা আমজাদ হোসেনদের মূল্যায়ন করতে পারিনি। কয়েকটা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার ছাড়া তেমন কিছুই দিতে পারিনি। অথচ এখনো আমজাদ হোসেনের অনেক কিছু দেওয়ার বাকি ছিলো।
একজন চলচ্চিত্রপ্রেমী হিসেবে আমজাদ হোসেনের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা আর প্রাণভরা ভালোবাসা…