পৃথিবীর নিশংসতম জায়গাগুলোর তালিকায় ক্যাম্প-২২ এমন একটি জায়গা, যেখানে মানুষকে কখনোই মানুষের চোখে দেখা হত না। বরং এখানে মানুষকে ব্যবহার করে ভয়াবহ সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হত। এখানে প্রসূতি নারীদের সরাসরি পেট কেটে ভ্রূণ বের করে ফেলা হতো, কখনো বা বড় তক্তা দিয়ে পিষে পিষে গর্ভপাত করানো হতো ৮-৯ মাসের প্রসূতিকে ! এখানে অভুক্ত শিশুরা সামান্য খাবারের জন্য প্রহরীর লাথি খেয়ে মারা পড়তো। এছাড়াও নারীদের নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে মেরে ফেলে হত।
উত্তর কোরিয়ার Haengyong Concentration Camp কে ক্যাম্প-২২ বলা হত। এখানে সেসব মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হতো যারা রাজনৈতিক সমালোচনা বা রাজনৈতিক ‘অপরাধী’। তবে উত্তর কোরিয়ার নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা অপরাধী নিজে তো জেলখানায় যেতই, তার সাথে সাথে তার ৩ প্রজন্মকেও জেলখানায় পচতে হতো। এমনকি জেলখানায় জন্মানো শিশুটিও নিস্তার পেত না !
উত্তর কোরিয়ার উত্তর পূর্ব সীমান্তে হোয়ের ইয়ং কাউন্টিতে ২২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই নরকের অবস্থান ছিলো। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা এই ক্যাম্প ১০ ফুট চওড়া ৩,৩০০ ভোল্টের বৈদ্যুতিক বেড়া দিয়ে আবৃত। কঠোর নিরাপত্তা এবং ক্যাম্প পরিচালনার জন্য প্রায় ১,০০০ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং প্রশিক্ষিত কুকুরসহ পাহারাদার এবং ৫০০–৬০০ কর্মকর্তা ছিলো। কিছুদূর পর পর ল্যান্ড মাইন এবং মানুষ মারার গোপন ফাঁদ ছিল এখানে। প্রায় ৫০ হাজার নারী পুরুষ ও শিশুবন্দী ছিল বলে জানা যায়। এরকম ভয়াবহ নরক উত্তর কোরিয়ায় আরো রয়েছে। এসব ক্যাম্পের বন্দীদের দিয়ে চাষবাস থেকে শুরু করে কারখানার কাজও করানো হয়। উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতির একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এই ক্যাম্পগুলোর শিল্পোৎপাদন।
এত কঠোর নিরাপত্তার পরও বহির্বিশ্বের মানুষ এই ক্যাম্পগুলোর অস্তিত্ব এবং এর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পেরেছে সেই সব মানুষের কাছ থেকে যারা একসময় এই ক্যাম্প-২২ এর কর্মী হিসেবে ছিলেন এবং কেউবা পালিয়ে এসেছেন সেই নরক থেকে।
ডেভিড হক নামে এক মানবাধিকার গবেষক ক্যাম্প-২২ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। তিনি ক্যাম্পের কিছু সাবেক পাহারাদার এবং পালিয়ে আসা বন্দিদের কাছ থেকে বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নেন। ম্যাং চল নামক এক প্রহরী ক্যাম্পে বন্দীদের কী ধরণের নির্যাতন করা হতো সব কিছুর বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, কেউ যদি একবার এখানে ঢুকত, তবে তিন মাসের মাঝেই মারা যেত। আর না মারা গেলেও সারা জীবনের জন্য অথর্ব হয়ে যেত।
এখানে গার্ডদের ট্রেনিং এর সময় বলা হতো, ক্যাম্পের বন্দীরা মানুষ নয়, তাদের সাথে কুকুর বিড়ালের মতো আচরণ করতে হবে। আর গার্ড চাইলেই যেকোনো বন্দীকে যখন খুশি মেরে ফেলতে পারবে। এ ব্যাপারে কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। কখনো কখনো এমন হয়েছে, কোন বন্দীকে তলবের পর তার আসতে খানিক দেরি হয়েছে বা দুর্বলতার ধীর পায়ে হেঁটে এসেছে, এই অপরাধের জন্য গার্ড সেই বন্দীকে মেরে ফেলেছে।